প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন তত্ত্ব
১.১প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব
এডওয়ার্ড লি থর্নডাইক ছিলেন একজন আচরণবাদী মনোবিদ। তাঁর শিখন সম্পর্কিত তত্ত্বটি শিক্ষাক্ষেত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে উদ্দীপক (S) ও প্রতিক্রিয়ার (R) এর মধ্যে যথাযথ সংযোগ স্থাপন হল শিখন। সুতরাং শিখনের জন্য প্রয়োজন S-R । যেমন - একজন শিক্ষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে রাশিবিজ্ঞানের একটি অঙ্ক করতে দেওয়া হল, সে সমস্যাটি সমাধানের জন্য সঠিক সূত্র প্রয়োগ করল ও সঠিক ভাবে গণনা করে অঙ্কটি সমাধান করল। এক্ষেত্রে সমস্যা হল উদ্দীপক (s) এবং সূত্র ও গণনা হল প্রতিক্রিয়া (R) যখন S ও R -এর মধ্যে যথাযথ সংযোগ স্থাপন হয় তখনই শিক্ষার্থী সমস্যাটি সমাধান করতে পারে অর্থাৎ শিখন হয়। যেহেতু এক্ষেত্রে উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যথাযথ সংযোগ ঘটে তাই এটি সংযোজনবাদ নামে পরিচিত। সংযোজনবাদ হল বিভিন্ন মানসিক প্রতিক্রিয়া, যেমন - সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, ধারণা গঠন প্রভৃতির সংযোগের ফল। সংযোজনবাদ সম্পর্কিত থর্নডাইকের শিখন তত্ত্বটি প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব নামে পরিচিত।
১.২ প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্বের পরীক্ষা
এই তত্ত্বটিকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন ইতর প্রাণী ও মানুষদের নিয়ে পরীক্ষা করলেও ক্ষুধার্ত বিড়াল নিয়ে যে পরীক্ষাটি করেন সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনোবিদ থর্নডাইক তাঁর প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্বের পরীক্ষার জন্য বিশেষ যান্ত্রিক কৌশলে একটি বক্স তৈরি করেন। এই বক্সের মধ্যে একটি মাত্র দরজা থাকে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য,যা ছিটকিনি দিয়ে আটকানো থাকে। ছিটকিনির সঙ্গে বক্সের মেঝেতে একটি বোতামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে এমন ভাবে যাতে বোতামে চাপ পড়লে বক্সের দরজা খুলে যায়। থর্নডাইক এই বক্সটিকেই পাজল বক্স বলেছেন। প্রথমে থর্নডাইক একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালকে পাজল বক্সের মধ্যে ভরে ছিটকিনি দিয়ে দেন ও বাইরে খাদ্যবস্তু হিসেবে মাছ রেখে পর্যবেক্ষণ করেন। ক্ষুধার্ত বিড়ালটিকে বক্সের মধ্যে রাখার পর থর্নডাইক দেখলেন বিড়ালটি বক্স থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে রাখা খাবার খাওয়ার জন্য বক্সের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে লাফালাফি করছে। এক্ষেত্রে চাহিদা ও খাদ্যবস্তুর মধ্যে বাধা হল বক্সের দরজা।বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর হঠাৎই বিড়ালটির শরীরের কোনো অংশের দ্বারা বোতামে চাপ পড়ার ফলে বক্সের দরজা খুলে যায় এবং বিড়ালটি বক্স থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে রাখা খাবার খেয়ে নেয়।
থর্নডাইক এইভাবে কয়েকদিন একই পরীক্ষা পুনরাবৃত্তি করলেন এবং দেখলেন যে যত দিন যাচ্ছে বিড়ালের উদ্দেশ্যহীন ভাবে লাফালাফির সংখ্যা কমছে অর্থাৎ বিড়ালটি পূর্বের ভুল আচরণ গুলি পুনরাবৃত্তি না করে পূর্বের থেকে অনেক কম সময়ে বক্সের থেকে বেরিয়ে আসছে।
এভাবে বারবার পুনরাবৃত্তিতে দেখা যায়, বিড়ালটি ক্রমশ ভুল প্রচেষ্টা গুলিকে পরিত্যাগ করে নির্ভুল প্রচেষ্টা গুলিকে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আচরণের স্থায়ী রূপে গ্ৰহন করছে। অর্থাৎ বিড়ালটির শিখন সম্পূর্ণ হয়েছে।
১.৩ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত
থর্নডাইক পরীক্ষাটি থেকে তিনটি সিদ্ধান্ত আসেন - (১) প্রাণী সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষভাবে সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শেখে।(২) পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শিখনের স্থায়ীকরণ হয়।(৩) আত্মসক্রিয়তা শিখনের মূল ভিত্তি।
১.৪ প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনের বৈশিষ্ট্য
প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনের বৈশিষ্ট্য গুলি হল -
(১) শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা
প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে।আর শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজন চাহিদা। থর্নডাইকের পরীক্ষায় বিড়ালটি যদি ক্ষুধার্ত না হত তাহলে খাদ্যের জন্য বাইরে আসতে সক্রিয় হত না।
(২) লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা
লক্ষ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীর ধারণা থাকা আবশ্যক।
(৩) যান্ত্রিকতা
এই প্রক্রিয়ায় চিন্তা, বুদ্ধি, পরিকল্পনা ইত্যাদির কোনো ভূমিকা নেই। সম্পূর্ণ যান্ত্রিক উপায়ে ভুল প্রচেষ্টা গুলি বাতিল হয় ও সঠিক প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট হয়।
(৪) পুনরাবৃত্তি
সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে উদ্দীপক এবং প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বারবার সংযোগ ঘটিয়ে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়াটি শনাক্ত করা হয়।
(৫) ক্রমহ্রাহ
প্রচেষ্টার সংখ্যা এবং সময় ক্রমশ হ্রাস পায়।
(৬) বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি
প্রচেষ্টা ও ভুলের পদ্ধতিতে শিখনকালে প্রাণী একই পরিস্থিতিতে নানা প্রতিক্রিয়া করে।
(৭) প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা
এই প্রকার শিখনে প্রাণী বা শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়।
১.৫ শিখনের সূত্রাবলি
বিভিন্ন পরীক্ষার পর থর্নডাইক শিখনের কতগুলি সূত্রের কথা বলেছেন।এর মধ্যে প্রথম তিনটি মুখ্য সূত্র ও পাঁচটি গৌণ সূত্র রয়েছে, অর্থাৎ মোট আটটি সূত্র রয়েছে।
( A) মুখ্য সূত্র
মুখ্য সূত্র গুলি হল -
১. প্রস্তুতির সূত্র
কোনো উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। সেজন্য যে কাজ শিক্ষার্থী প্রস্তুত বা উম্মুখ, সেই কাজে তার তৃপ্তি আসে,আর প্রস্তুত বা উম্মুখতা না থাকলে বিরক্তি আসে
২. অনুশীলনের সূত্র
একটি উদ্দীপকের সাথে একটি প্রতিক্রিয়াকে যদি বারবার সংযোগ করা হয় অর্থাৎ অনুশীলন করা হয়, তাহলে সংযোগ দৃঢ় হয়। যদি বহুদিন সংযোগ স্থাপন না হয় অর্থাৎ অনুশীলন বন্ধ হয় , তবে সংযোগ শিথিল হবে।
থর্নডাইক এই সূত্রটিকে দুই ভাগে ভাগ করে বলেছেন - অভ্যাসের সূত্র এবং অনভ্যাসের সূত্র।
৩. ফললাভের সূত্র
উদ্দীপক - প্রতিক্রিয়ার সংযোজনের ফল যদি তৃপ্তিদায়ক হয়, তবে সংযোজন দৃঢ় হয় আর যদি ফল অতৃপ্তিদায়ক হয় তাহলে সংযোজন দুর্বল হবে।
( B) গৌণ সূত্র
গৌণ সূত্র গুলি হল -
(১) বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার সূত্র
উদ্দীপক - প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের পূর্বে প্রাণী বিভিন্ন ধরনের আচরণ বা প্রতিক্রিয়া বা প্রচেষ্টা করে থাকে।এর মধ্যে থেকে নির্ভুল প্রতিক্রিয়াকে বেছে নেওয়াই হল শিখন। বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা যার যত বেশি হবে ততই তার শিখনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
(২) মানসিক অবস্থার সূত্র
শিখনের জন্য চাই মানসিক প্রস্তুতি। উপযুক্ত মানসিক অবস্থার তৈরি না হলে শিখন সার্থক হয় না।
(৩) আংশিক প্রতিক্রিয়ার সূত্র
শিখনের জন্য সামগ্রিক অবস্থার প্রত্যক্ষণ না হলেও হয়।সমগ্ৰ অংশকে ছোটো ছোটো অংশে বিভক্ত করে প্রতিটি অংশের প্রতি বিশেষ প্রতিক্রিয়া করেই শিখন সম্ভব হয়।
(৪) সাদৃশ্যের সূত্র
নতুন কোনো অবস্থার সম্মুখীন হলে আমরা পূর্বের কোনো অবস্থার সঙ্গে নতুন অবস্থার মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করি এবং সেভাবেই প্রতিক্রিয়া করি।
(৫) অনুষঙ্গমূলক সঞ্চালনেল সূত্র
কোনো উদ্দীপকের সাথে স্বাভাবিক ভাবে যুক্ত কোনো প্রতিক্রিয়াকে অন্য উদ্দীপকের সাথেও সংযোজন করা যেতে পারে। যেমন - তেঁতুল খেলে জিভে জল আসে। পরবর্তীতে তেঁতুল দেখালেই জিভে জল আসে।এই ঘটনাটি প্যাভলভের অনুবর্তনের ধারণা সাথে যুক্ত।
১.৬ প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য
প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য গুলি হল -
(১) শিক্ষকের দায়িত্ব
থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন তত্ত্ব শিক্ষাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে । এতদিন শিক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণ হিসেবে বৌদ্ধক ঘাটতিকে দায়ী করা হত। মনে করা হত, এক্ষেত্রে শিক্ষকের বিশেষ কিছু নেই। প্রচেষ্টা ও ভুলের মতবাদের মাধ্যমে এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে, শিক্ষার্থীর অকৃতকার্যতার জন্য দায়ী শিক্ষকের দক্ষতার অভাব। এর ফলে শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
(২) শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি ও আগ্ৰহ সৃষ্টি
শিখনের সাফল্য নির্ভর করে পাঠ্য বিষয়বস্তু জন্য শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক প্রস্তুতির ওপর। তাই বিষয়বস্তু নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
(৩) শিক্ষকের আংশিক সহযোগিতা
সমস্যা সমাধানে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ ভাবে সাহায্য না করে আংশিক ভাবে সাহায্য করবেন, যাতে শিক্ষার্থীর মধ্যে আগ্ৰহের সঞ্চার হয় ও সমস্যার সমাধানে সে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
(৪) অনুশীলন
শিখন প্রক্রিয়া অনুশীলনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
তাই পাঠ্য বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে বারবার অনুশীলন করার সুযোগ পায় এদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। অনুশীলন যাতে যান্ত্রিক উপায়ে না হয় তার ব্যবস্থাও করতে হবে।
(৫) শাস্তি প্রদান না করা
প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব অনুসারে নতুন শিখনে শিক্ষার্থীর ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই শিক্ষার্থীর কোনোরকম শাস্তি পাওয়া উচিত নয় বা যথার্থ নয়।
(৬) পুর্ব- অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমস্যা উপস্থাপনা
এ ধরনের শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামনে এমনভাবে সমস্যা উপস্থিত করতে হবে যাতে সে পুর্ব- অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমান সমস্যার সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
Comments
Post a Comment